কলকাতা: শনিবার দুটো ঝড়ের সাক্ষী থাকল ইডেন গার্ডেন্স। প্রথমে আন্দ্রে রাসেলের ব্যাটে। দ্বিতীয় বার হেনরিখ ক্লাসেনের ব্যাটে। দ্বিতীয় ঝড়ের কারণে একটা সময় হেরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল কলকাতার। তা হল না হর্ষিত রানার সৌজন্যে। তরুণ জোরে বোলার দাম দিলেন শ্রেয়স আয়ার, গৌতম গম্ভীরের আস্থার। শেষ ওভারে বল করতে এসে ঠান্ডা মাথা রেখে ক্লাসেনকে ফেরালেন। দুটো উইকেট নিয়ে, ১৩ রান ধরে রেখে জিতিয়ে দিলেন কলকাতাকে। কলকাতার তোলা ২০৮/৭-এর জবাবে হায়দরাবাদ থেমে গেল ২০৪/৭-এই।
কোনও মতে প্রথম ম্যাচ জিতলেও এই কলকাতা দলকে নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম চিন্তা অবশ্যই মিচেল স্টার্ক। ২৪.৭৫ কোটি টাকা দিয়ে যাঁকে কেনা হয়েছে, যাঁর প্রতিটি বলের দাম ৬ লক্ষ টাকা, তিনি চার ওভারে দিলেন ৫৫ রান। ওভার প্রতি ১৩.৭৫। উইকেট মাত্র ১টি। হর্ষিত, সুযশের মতো ভারতীয় ক্রিকেটের অখ্যাত তরুণেরা স্টার্কের থেকে ভাল বল করলেন। এই বোলারের পিছনে কেন কলকাতা ছুটল আর কেনই বা এত টাকা খরচ করল, তা দল পরিচালন সমিতিই ভাল বলতে পারবে। এই স্টার্ককে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখা যায় না, এটা প্রথম ম্যাচেই বোঝা গিয়েছে। স্টার্কের পিছনে যে খরচ হয়েছে, তাতে স্বদেশি কয়েকজন বোলারকে অনায়াসে নেওয়া যেত।
দ্বিতীয় চিন্তার কারণ অবশ্যই ভঙ্গুর ব্যাটিং। কেন ওপেনিং জুটিতে আচমকা বদল করা হল, কেন মিডল অর্ডার ও ভাবে ভেঙে পড়ল, তার কারণ খুঁজতে হবে দ্রুত। টপ অর্ডার ভাল শুরু না করলে পরের দিকের ম্যাচগুলিতে বিপদে পড়তে হতে পারে।
কলকাতার প্রথম চমকটা ছিল ওপেনিং জুটিতেই। শুক্রবার পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল বেঙ্কটেশ আয়ারের সঙ্গে ফিল সল্ট বা রহমানুল্লাহ গুরবাজ়ের মধ্যে কেউ ওপেন করতে পারেন। ম্যাচের আগে টিম হাড্লে সল্টের হাতে টুপি তুলে দেওয়ায় নিশ্চিত হওয়া গেল তিনিই খেলছেন। কিন্তু কলকাতা ব্যাট করতে নামার সময়েই চমক। সল্টের সঙ্গে যিনি এগিয়ে আসছিলেন ক্রিজ়ের দিকে, তিনি বেঙ্কটেশ নন, সুনীল নারাইন। অতীতে তাঁকে ফাটকা হিসাবে ওপেনিংয়ে খেলানো হয়েছে। কিন্তু আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই পরীক্ষা কেন?
যা হওয়ার ছিল তাই হল। নারাইন কোনও অবদান রাখতেই পারলেন না। উল্টে নিরামিষ একটা বলে রান আউট হলেন। সল্ট অনেক আগেই রান নেবেন না জানিয়েছিলেন। তত ক্ষণে নারাইন মাঝ পিচে। সবচেয়ে বড় কথা, ফিল্ডার বল ছোড়ার আগে ক্রিজ়ে ফেরার আগ্রহ টুকু পর্যন্ত দেখালেন না। হেলতে-দুলতে ফিরতে গেলেন। শাহবাজ় আহমেদের থ্রো সরাসরি উইকেট ভেঙে দিল।
এর পর কলকাতা দলে আয়ারাম-গয়ারামদের মিছিল। বেঙ্কটেশ তিনে নামলেন। উল্টো দিকে সল্ট আগ্রাসী খেলতে থাকা সত্ত্বেও নিজে অনাবশ্যক ঝুঁকি নিতে গেলেন। নটরাজনের বলে যে শটটি খেললেন তার কোনও দরকার ছিল না। সোজা গেল মার্কো জানসেনের হাতে। পর পর দুটো উইকেট পড়ায় দরকার ছিল এমন একজনের নামার যিনি ধরে খেলতে পারেন। নীতীশ রানাকে নামানো যেত। এখানেই ভুল করল কলকাতা। নামলেন শ্রেয়স আয়ার। দ্বিতীয় বলেই তাড়াহুড়ো করে ছয় মারতে গেলেন। কভারে ক্যাচ ধরতে প্যাট কামিন্সের কোনও অসুবিধাই হল না।
এখানেই কলকাতার ক্রিকেটারদের ‘সাহসিকতা’ থামেনি। নীতীশই বাদ যাননি সেই তালিকা থেকে। দিব্যি সল্টের সঙ্গে খেলছিলেন। একটি ছক্কা মেরে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিলেন। হঠাৎ করে ডান হাতি হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা দেখা গেল। রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে মারকান্ডের বলে ক্যাচ দিলেন রাহুল ত্রিপাঠির হাতে।
ইডেন প্রত্যাশা করেছিল রিঙ্কু সিংহের। বদলে নামলেন আর এক সিংহ, রমনদীপ। শ্রেয়স, নীতীশদের মতো অপরিণত মানসিকতা তিনি দেখাতে চাননি। ধরে ধরে খেলে ইনিংস এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলেন। উল্টো দিকে যে সল্ট আগ্রাসী ছিলেন, তিনিও কিছুটা গুটিয়ে রমনদীপের মতোই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেন। তাতে রান তোলার গতি কমে গেল ঠিকই, কিন্তু কলকাতা ব্যাটিং-ধস সামাল দেওয়া গেল। রমনদীপ মারার বল মারছিলেন, ধরার বল ধরে খেলছিলেন। পঞ্চম উইকেটে সল্ট-রমনদীপের ৫৪ রানের জুটি কলকাতাকে অনেকটা এগিয়ে দিল।
কয়েক বলের ব্যবধানে সল্ট (৫৪) এবং রমনদীপ (৩৫) ফিরে যাওয়ার পর আবার চাপে পড়েছিল কলকাতা। কিন্তু খেলা ঘুরিয়ে দিলেন একা তিনি, আন্দ্রে রাসেল। গত মরসুমে তাঁর ব্যাটে রানের আশায় হাপিত্যেশ করে বসেছিলেন কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীরা। কিন্তু রাসেল-ঝড় ওঠেনি। শনিবারের ইডেন রাসেল-ঝড় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল। প্রথম কয়েকটা বলে রাসেল ধরে খেলছিলেন। কিন্তু স্পিনারেরা আসতেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। মারকান্ডের এক ওভারে মারলেন তিনটি ছয়।
এর পর আর তাঁকে ধরে রাখা যায়নি। রাসেল-ঝড়ের সামনে যে-ই এল, খড়কুটোর মতো উড়ে গেল। ১৯তম ওভারে ভুবনেশ্বর কুমারকে ছয় মেরে ২০ বলে অর্ধশতরান করলেন। তত ক্ষণে হায়দরাবাদের বোলারেরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন। উল্টো দিক থেকে রিঙ্কুরও ব্যাট চলতে শুরু করেছে। যে কলকাতাকে দেখে একসময় মনে হচ্ছিল দেড়শোও পেরোবে না, তারাই রাসেল-রিঙ্কুর সৌজন্যে দুশো পার করে ফেলল। রাসেল অপরাজিত থাকলেন ৬৫ রানে।
কলকাতার বোলিংয়ের সময় নজর ছিল ২৪.৭৫ কোটির স্টার্কের দিকে। প্রথম ওভারেই বল করতে এলেন তিনি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী হতাশ করলেন শুরুতেই। তৃতীয় বলেই ওয়াইডে গেল পাঁচ রান। যাঁর এক-একটি বলের দাম ৬ লক্ষ টাকা, তিনি প্রথম ওভারেই দিলেন ১২। দ্বিতীয় ওভারে ১০। কলকাতার পেস বোলিং বিভাগ এমনিতেই দুর্বল। হর্ষিত রানা কোনও দিন স্টার্কের পাশে বল করবেন ভাবাও যায়নি। বিকল্পের অভাবে তাঁকেই খেলাতে হয়েছে। প্রথম ওভারে ৫ রান দিলেও দ্বিতীয় ওভারে দিলেন ১৩।
শ্রেয়স এর পর স্পিনার নিয়ে এলেও লাভ হয়নি বিশেষ। বরুণ চক্রবর্তী প্রথম ওভারে দিলেন ১৮। ওপেনিং জুটিতে ৫০ রান উঠে গেল। প্রথম ধাক্কা দিলেন হর্ষিত। মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে ফেরালেন। সুনীল নারাইন এসে নিজের কাজ শুরু করলেন। প্রথম ওভারে দিলেন মাত্র ২ রান। পরের ওভারেই রাসেল তুলে নিলেন অভিষেক শর্মাকে। নারাইনের দ্বিতীয় ওভারে রাহুলের সহজ ক্যাচ বরুণ ফেলে না দিলে সেখানেই চাপে পড়ে যায় হায়দরাবাদ।
রাহুল এবং এডেন মার্করাম নেমে ম্যাচ প্রায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছিলেন। কলকাতার বোলারদের বলও বেশ খারাপ হচ্ছিল। কলকাতা ম্যাচে ফিরল বরুণের হাত ধরে। নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে এসে তুলে নিলেন মার্করামকে। ঝাঁপিয়ে ক্যাচ ধরার জন্য রিঙ্কুরও প্রশংসা প্রাপ্য। পরের ওভারে রাহুলকে তুলে নিলেন নারাইন। দুই সেট হয়ে যাওয়া ব্যাটার হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় হায়দরাবাদ।
তখনও ছিলেন হেনরিখ ক্লাসেন, যাকে ক্রিকেটবিশ্ব ধ্বংসাত্মক ব্যাটার হিসাবেই চেনে। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছিলেন আব্দুল সামাদ। সেই সামাদকে আউট করলেন রাসেলই। সেই ওভারে ১৬ উঠলেও তখনও ম্যাচে ভাল ভাবেই ছিল কলকাতা। কিন্তু পরিস্থিতি কঠিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাসেনের আসল রূপ বেরিয়ে এল। ১৮তম ওভারে বরুণ দিলেন ২১ রান। পরের ওভারে স্টার্ক দিলেন ২৬। দলের দুই অভিজ্ঞ বোলার এ ভাবে মার খাওয়াতে দুমড়ে গিয়েছিল কলকাতার ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস।
একজনের মধ্যে তখনও বেঁচেছিল। তিনি হর্ষিত। শেষ ওভারে প্রথম বলে ছয় খেয়েও ঘাবড়ে যাননি। এমন নয় যে তার আগে আহামরি বল করেছেন। কিন্তু নায়ক হন তিনিই যিনি চাপের মুখে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। যেটা পেরেছেন হর্ষিত। যেখানে ডাহা ফেল স্টার্ক, বরুণ।